![]() |
সাগর দেশে বিজ্ঞানী হাকাটাম কুরেশী |
সাগর দেশে বিজ্ঞানী হাকাটাম কুরেশী
লেখক: মতিউর রহমান
সবে মাত্র জিটি-নটিলাস ভূমধ্যসাগরের জল পথ ছেড়ে আটলান্টিকের জলপথে প্রবেশ করেছ। জিটি-নটিলাস ফ্রান্সের একটি প্রাইভেট জাহাজ। অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরে কাছে এটি ভাড়া দেয়া হয়। তেমনি ভাবে এখন জাহাজটি বিজ্ঞানী হাকাটাম কুরেশীর কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসছে। বিজ্ঞানী হাকাটাম কুরেশী কিছুক্ষণ আগে রান্না শেষ করেছেন এবং গোসল করে নিয়ে বসে আছেন জাহাজের ডেকে। বিজ্ঞানীর মন এখন দূর সাগরের দিকে। তিনি, একবার তাকাচ্ছেন পশ্চিমে তো পরমূর্হুতে তাকাচ্ছেন পুর্বদিকে।
বিজ্ঞানী যখন পশ্চিমে তাকাচ্ছেন, সেদিকে যতদূর চোখ যায় আটলান্টিকের সুবিশাল জলরাশি ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। পূর্বদিকে কিন্তু আবার সেরকম না। বহুদূর জল পেরিয়ে আবছাভাবে দেখা যায় মরক্কো উপকূল। দেখে মনে হয় আর কিছুক্ষণ পর বিশাল জলরাশির তলায় হারিয়ে যাবে উপকূলটা। এই বিচিত্র পরিবেশে হঠাৎ চোখ বুজলেন বিজ্ঞানী হাকাটাম কুরেশী।
ঘটনাটি ঘটছে বিজ্ঞানী মারা যাবার প্রায় ১২ বছর আগে। ১৮৮২সালে এক ভোরে ইংল্যান্ড পুলিশ তার ছোট ল্যাবরেটরি থেকে বিজ্ঞানীর মৃত দেহ উদ্ধার করে। তারপর থেকে দীর্ঘ দিন কেটে যায়। অনেক খোজঁ খবর করার পরও তার আবিষ্কৃত হরমোনের ব্যাপারে কোন তথ্য কেউ উদ্ধার করতে পারেনি। আস্তে আস্তে তার এই হঠাৎ মৃত্যুর ঘটনা সময়ের তলায় হারিয়ে যায়।
তার মৃত্যুর অনকে দিন পার হাকাটাম কুরেশীর ছেলে মোস্তাবিদা কুরেশী, একদিন তার বাবার ব্যবহারের ল্যারেটরিতে প্রবেশ করে। মোস্তাবিদা কুরেশী প্রত্নতত্ত্বের ছাত্র। লন্ডন ইউনিভার্সটি থেকে প্রত্নতত্ত্বে ডিগ্রি নিয়ে চাকরীসূত্রে ১০ বছরের জন্য পাড়ি জমায় ভারত উপমহাদেশে। যার কারণে বাবার মৃত্যুর সময় সামনে উপস্থিত থাকতে পারেনি মোস্তাবিদা কুরেশী।
মোস্তাবিদা কুরেশী ল্যাবরেটরিতে প্রবেশ করে সবকিছু খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগল। বাবার ব্যবহারের প্রতিটি বস্তু সে একে একে পরিক্ষা করল। সে লক্ষ্য করল ল্যাবরেটরির সকল জিনিস পত্র এলমেল ভাবে পড়ে আছে। প্রথমে সে সবকিছুকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে নিল। সাজাতে গিয়ে সে খোঁজে পেল একটা হলুদ রংয়ের ডায়েরি। ডায়েরি খোঁজার কোন উদ্দেশ্য তার ছিল না। যেহেতু ডায়েরিটা পেল তাই সে ডায়েরিটা পড়া ইচ্ছা অনুভব করল। ডায়রিটা পড়ার জন্য সে বসে পড়ল পাশের চেয়ারে। এই সেই চেয়ার, যে চেয়ারে তার বাবা বিজ্ঞানী কুরেশী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
তারপর মোস্তাবিদা কুরেশী ডায়েরীটা খুলে পড়তে শুরু করল।
ডায়েরির পাতা এখানে হুবহু উল্লেখ্ করে দিলাম।
১৮৭০ সালে জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমরা তিন বন্ধু ফ্রান্স থেকে কেপটাউনের উদ্দেশ্যে জিটি-নটিলাস নামক জাহাজ নিয়ে যাত্রা শুরু করি। একনাগারে প্রায় ২০দিন চলার পর আমরা আটলান্টিকের দেখা পাই। তারপর চলতে শুরু করি দক্ষিনের দিকে।
এই যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল একধরণের মাছ। যা আফ্রিকার উপকূল বা তার আশপাশ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এ ধরণের মাছ আমি যে হরমোন আবিষ্কার করতে যাচ্ছি সেক্ষেত্রে গুরুত্বপর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাছাড়া গবেষনার জন্য একটা নির্মল পরিবেশ দরকার যেটা আমি জাহাজের ডেকে খোজে পেয়েছি। যদিও জাহাজ কিংবা সমুদ্র, গবেষনার জন্য উপযোক্ত স্থান নয়।
প্রায় তিন মাস পর আমরা এসে পৌছালাম কেপটাউনের বন্দরে। জাহাজ যখন বন্দরে এসে দাড়াল তখন রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে। চার দিকে ভোরে আলো ফুটতে শুরু করেছে। এতো বড় একটা জাহাজ এসে, বন্দরে নোঙর করল কিন্তু আশেপাশে কোন মানুষ দেখা যচ্ছে না। আরও জাহাজ দাড়িয়ে আছে কিন্তু তাতে কোন মানুষ জন আছে বলে মনে হচ্ছে না। হয় তো সবাই ঘুমিয়ে আছে।
আমরা যারা জাহাজে করে এসেছি প্রত্যেকেই জাহাজ ছেড়ে ডাঙ্গায় নেমে আসলাম শুধু মাত্র জাহাজের ক্যা্প্টেন জাহাজে থেকে গেলেন।
কিছুক্ষনের মধ্যে সূর্য্ ওঠল। চারদিকের আবছা অন্ধকার কেটে গিয়ে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। আমরা যেখানটায় আছি এটা কোন সমূদ্র বন্দর না, বিশাল একটা সমুদ্র সৈকত। এখানে আমাদের জাহাজ ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি জাহাজ নোঙর করা আছে। কিন্তু জাহাজ গুলো কার বা কারা নিয়ে এসেছে এসবের কোন সন্ধান করতে পারছি না আমরা কেউই। তাছাড়া আমরা ছাড়া এখানে অন্য কোন মানুষকে দেখা যাচ্ছে না। এতগুলো জাহাজ কিন্তু একজনও মানুষ নেই।
আমি আমাদের জাহাজের ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞাস করলাম, “আমার কোথায় এসেছি এসর্ম্পকে আপনার মন্তব্য কি?” ক্যা্প্টেন কোন জবাব দিল না। ক্যাপ্টেনের এই নিঃশব্দতায় আমার এক বন্ধু রেগে গিয়ে প্রশ্ন করল, কি হয়েছে কথা বলছেন না কেন?
জাহাজের ক্যাপ্টেন আমতা আমতা করে বলল, আমরা এখন গ্যাবনে আছি। আমি একটু উত্তেজিত হয়ে বললাম, গ্যাবন!
ক্যাপ্টেন বলল, জ্বি স্যার। এখন এখানে যুদ্ধ চলছে। ফ্রান্সের কাছ থেকে গ্যাবন স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করছে। এই জায়গা হচ্ছে যুদ্ধাদের আস্তানা। আমরা যারা জাহাজে কাজ করি তারা প্রত্যেকেই জানি যে, ক্যানারী উপকূল পার হওয়ার পর থেকে গ্যাবন বা এর আশপাশের এলাকায় এসব সৈনিকেরা আস্তানা পাতে। যদি কেউ ভুল করে তাদের এলাকায় প্রবেশ করে তাহলে কেউ তাদের হাত থেকে ফিরে যেতে পারে না।
ক্যাপ্টেনের কথা শেষ হতে না হতে আমি সবাইকে জাহাজের ওঠার নির্দেশ দিয়ে, ছুটে গেলাম নোঙর করা অন্য জাহাজ গুলোর দিকে। জাহাজ গুলোর কোনোটা নতুন কোনোটা পুরাতন। কাছের একটা জাহাজে ওঠলাম। ভেতরে তেমন কিছু নেই। ডেকের মেজেতে এলমেল ভাবে পড়ে আছে কিছু পাথর আর বর্শা জাতীয় কোন কিছু।
কেবিনে গিয়ে একটু উকি মারতে দেখতে পেলাম থাটের উপরে কত গুলো বন্ধুক রাখা আছে। কিন্তু খাটের তলার কংকাল গুলোকে দেখে আমি একটু ভয় পেলাম। তবে অদ্ভুত বিষয় হলো পাশের টেবিলে স্তুপাকারে রাখা আছে প্রাচীন সব সাহিত্যের বই। ভিতরে ডুকে সবকিছুকে ওলঠে পাল্টে দেখতে শুরু করলাম।
হঠাৎ বাইরে হৈচৈ শুনতে পেয়ে আমি কেবিন থেকে বেড়িয়ে এলাম, বাইরে বেড়িয়ে দেখি, আমি যে জাহাজে ওঠেছি সেটাকে গিরে দাড়িয়েছে প্রায় ১০/১২ জন সৈনিক। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ পকেট থেকে হাইডোক্লোরাইড ও ফসফেট জাতীয় দুই রকম পাউডার একসাথে করে ছুরে মারলাম প্রতিপক্ষের দিকে। সাথে সাথে সেই স্থানে একধরনে ধোয়ার সৃষ্টি হলো। এই সুযোগে আমি দৌড় দিলাম নিজের জাহাজের দিকে। ততক্ষনে আমাদের জাহাজ চলতে শুরু করেছে গভীর সমুদ্রের উদ্দেশ্যে। আমি দৌড়ে গিয়ে জাহাজের রেলিংএ জুলে পড়লাম। সাথে সাথে এক বন্ধু হাত বাড়িয়ে আমাকে ডেকে তুলে নিল।
এমন সময় এক সৈনিক দৌড়ে এসে আমাকে লক্ষ্য করে গুলি করল কিন্তু গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আমার গায়ে না লেগে লাগলো আমার পাশে থাকা বন্ধুর বুকে। সে লুটিয়ে পড়ল ডেকের ওপর, সাথে সাথে চারদিক রক্তে লাল হয়ে ওঠলো। আমি ওঠে দাড়িয়ে পাশে থাকা লোহার লংগরটা ছুড়ে মারলাম সৈনিকের দিকে। কিন্তু লংগর সৈনিকের কাছ পর্যন্ত যেতে পাড়ল না। দূরে জলের মধ্যে আছরে পড়ল। আমরা দ্রুত জাহাজটাকে গভীর সমুদ্রে নিয়ে আসলাম।ঐরাতে বন্ধুটি মারা যায়। আটলান্টিকের জলেই সলিল সমাধি হলো তার।
এখন রাত, ডেকে দাড়িয়ে আছি। হঠাৎ চোখ পড়ল লংগরটার দিকে। লংগরটার মাথায় আটকে আছে অদ্ভুত রকমের একটা মাছ। যে বস্তুটার উদ্দ্যেশে আমরা্ এতো দূর যাচ্ছি সেটা আমরা পেয়ে গেছি। তৎক্ষনাত ক্যাপ্টেনকে নির্দেশ দিলাম জাহাজ ইংল্যান্ডের দিকে ফিরিয়ে নিতে।
0 Comments